Ad Code

E-Book Entire: ebook selling is an excellent way of earn money

প্রযুক্তি- বইকে কেড়ে নিচ্ছে নাকি দিচ্ছে নতুনত্ব?


সাদিয়া ইসলাম : প্রযুক্তির উত্কর্ষ দিনকে দিন বেড়েই চলছে। আর একের পর এক মানব জীবনের নতুন নতুন সব ক্ষেত্রে এটি ফেলে চলেছে নিজের প্রভাব। মানুষ তার অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবা কথা আর স্মৃতিগুলো সবসময়েই আটকে রাখতে চেয়েছে কাগজের পাতায়। কলমের নানারকম আঁকিবুকিতে নিজেদের অভিজ্ঞতা আর চিন্তা পৌঁছে দিতে চেয়েছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
আর মানুষের এই অক্লান্ত চেষ্টার ফলেই সেই সুদূর অতীত থেকে এখন অব্দি রচিত হয়েছে লাখ লাখ বই। নানা ভাষার বই, নানা ধারার বই। মানব সভ্যতার একটা অবিচ্ছেদ্য অংশই হয়ে গিয়েছে বই এখন। কিন্তু প্রযুক্তি ছেড়ে কথা বলেনি মানুষের এই কালো কালির স্বর্ণসম্ভারকেও। ধীরে ধীরে আরো দশটা ক্ষেত্রের মতন ছাপা অক্ষরের সম্পদ বইকেও নিয়ে এসেছে প্রযুক্তি তার হাতের মুঠোয়।
তৈরি হয়েছে ই-বুক, ই-লাইব্রেরি, ই-বুকশপসহ আরো হাজারটা জিনিস, যাতে করে ছাপা হরফের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা পড়ে গিয়েছেন দুঃশ্চিন্তায়। সত্যিই কী একটা সময় সত্যিকারের বই পড়ার মতন মানুষ থাকবে না আর? সবাই কী হয়ে পড়বে একেবারেই প্রযুক্তিনির্ভর? অ্যামাজন, রকমারী, বেমস অ্যান্ড নোবেলস নুকসহ আরো অনেক ই-বই এর সম্ভার প্রতিনিয়তই এই শঙ্কা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে সবার মনে।
কোমা প্রেসের ডিজিটাল সম্পাদক জিম হিংকস এ নিয়ে বলেন, ‘সাহিত্য ইন্টারনেটের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছে!’ কে জানে! সত্যিই হয়তো তাই। কিন্তু একেবারেই কী সত্যি কথাটা? তাহলে এতদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও মানুষ কেন বই কেনে? কেন বই মেলা হয়? কেন এখনো লাইব্রেরি টিকে আছে আর টিকে আছে ছাপা হরফের বইগুলো? আসুন জেনে নিই।
ই-বুক
নতুনের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরন্তন। আর তাই নতুন কোন কিছুর সন্ধান পেলে মানুষ সেদিকেই মনযোগ দেয় প্রথমে। ঝাপিয়ে পড়ে। সেটা ভালোবেসেই হোক কিংবা না বেসে। আর ঠিক তেমনটাই লক্ষ্য করা যাবে যদি বছর বছর ই-বুক বিক্রির হিসেবটা দেখে নেওয়া যায়। হিসেবে দেখা যায়, আমাজান কিন্ডেল যেখানে ২০০৯ সালে ১৩.৪৪ মিলিয়নের ব্যবসা করেছে, সেখানে ২০১১ তে এসে সেটা নেমে গিয়েছে ৯.৭ মিলিয়নে। বেমস অ্যান্ড নোবেলস নুক প্রতিবছর ৭০ মিলিয়ন ডলারের পাঠক হারাতে শুরু করেছে। কমেছে বাকিদের ব্যবসাও! এ ছাড়া ২০১৪ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে ই-বুক এর জন্যে মানুষ মোট খরচ করেছে ৩৯৩ মিলিয়ন। যেখানে কিনা ছাপা হরফের বই এর জন্যে তারা ব্যয় করেছে ১.৭ বিলিয়ন। এই সংখ্যাগুলো হিসেব করলেই একজন অনভিজ্ঞ মানুষও এক কথায় সিদ্ধান্তে চলে আসতে পারবে যে ই-বুকের চাহিদা কমে যাচ্ছে।

একটা সময় হঠাৎ করেই ই-বুক এর প্রতি আকর্ষণ বেড়ে গেলেও বর্তমানে আবার ফিরে আসছে ছাপা বই। ছাপা বই এর চাহিদা হঠাৎ করে কমে যেতে শুরু করলেও সেই গতি এখন ধীর হয়েছে। কিছুদিন আগেও ছাপা বই এর দিন শেষ হয়ে এসেছে বলে মনে করা হলেও ব্যাপারটা এখন আর অতটা গ্রহণযোগ্য বলে মনে হচ্ছেনা। ধ্বংস থেকে অনেক অনেক দূরেই রয়েছে এখনো ছাপা বই। বর্তমানে বড়দের কিছু বই, আবেগঘন উপন্যাস ও ফিকশন ছাড়া আর সব বই এর চাহিদা আটকে রয়েছে সেই ছাপা বই এর ভেতরেই। বিশেষ করে রান্না ও ধর্মীয় বই এর চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে এবং সেটা একমাত্র ছাপা অক্ষরেই।
পার্থক্য কতটা?
সত্যিই কী ই-বুক আর সত্যিকারের বই খুব বেশি আলাদা কিছু? ২০১৪ সালে একটি পদক্ষেপ নেওয়া হয় এই ব্যাপারে। ‘দ্য গার্ল হু লস্ট হার নেম’ নামের একটি অনলাইন বই বের করা হয় বাচ্চাদের জন্যে। অষ্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেনের বাচ্চাদের কাছে প্রচন্ডরকম জনপ্রিয় হয় বইটি। সি বুক নামক স্প্যানিশ কোম্পানি ই-বুকগুলোকে ছাপা বই করে বিক্রি করার একটা প্রক্রিয়া শুরু করেছে এবং সেগুলো অনলাইনেই কেনার ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু তাই নয়, এভাবে তারা বিক্রি করতে শুরু করেছে ই-কার্ডও। এ প্রসঙ্গে সি বুকের পরিচালক ড. রোজা সালা রোজ বলেন, ‘এখনো অব্দি অনেক বইয়ের দোকান মনে করে ই-বুক তাদেরকে ধ্বংস করে ফেলবে।’

লন্ডনের একটি টেক-স্টার্ট আপ বুকিনডি প্রতিনিয়ত ছাপা বই কিনতে মানুষকে উত্সাহিত করে যাচ্ছে তাদের প্রযুক্তির মাধ্যমে। গুগল ক্রোমে অ্যামাজনের বই দেখতে গেলে সেখানেও নিকটস্থ বই এর দোকানে খুঁজতে থাকা বইটি কত টাকায় পাওয়া যাবে সেটাও বলে দিচ্ছে। এভাবে রোজই নিজেদের মতন করে প্রযুক্তি ছাপা বইকে সাহায্য করে আসছে।
পুরনো মদ নতুন বোতলে
পেঙ্গুইন বুক ডিজিটালের প্রধান অ্যানা রেফার্টি জানান, ‘ইদানিং প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলেই অনেক অনেক পুরনো ব্যাপার আমাদের সামনে আসছে। পুরনো লেখা ও লেখকের সঙ্গে পরিচিত হতে পারছি আমরা।’ নিজের কথার পক্ষে চার্লস ডিকেন্সের ১৮৩৬ সালে প্রকাশিত দ্য পিকউইক পেপার্সের কথা উল্লেখ করেন তিনি। শুধু তাই নয়, ইন্টারনেটের এই সহজপ্রাপ্যতা লেখকদের জন্যেও অনেক বেশি সুবিধা তৈরি করে দিচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
নিজেদের মেধা প্রকাশ করতে বর্তমানে লেখক আর প্রকাশকদেরকে অনেকটা কম পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। অ্যানা বলেন, ‘এটা লেখকদেরকেও সরাসরি বই প্রকাশ করবার উপায় করে দিচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে নিজের পাঠকদের কাছে যেতে ও নিজের লেখাকে অনুভব করার সুযোগ করে দিচ্ছে।’
এর পাশাপাশি বর্তমানে লেখকের কন্ঠকেও পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে ইন্টারনেট। প্রযুক্তির এই উত্কর্ষের ফলে বাসায় বসেই লেখকের নিজের কন্ঠের আবৃত্তি কিংবা পাঠ শুনতে পাচ্ছে শ্রোতারা। ফলে আনন্দের একটা ভিন্নমাত্রা যেমন তৈরি হচ্ছে, তেমনি তৈরি হচ্ছে বিশ্লেষনের একটা ক্ষেত্রও। লেখক সহজেই বুঝতে পারছেন যে, ঠিক কোন জায়গায় এসে পাঠক তাদের আকর্ষণ হারাচ্ছে এবং শোনা বন্ধ করে দিচ্ছে। ফলে নিজেকে যাচাই এরও একটা ভালো উপায় করে দিচ্ছে প্রযুক্তি লেখকদেরকে।
অনলাইনে রেটিংসের ব্যাপার রয়েছে। সেখানে পাঠকের মন্তব্য করার জায়গাও আছে। ফলে কোন বইটি ভালো কাজ করছে, কোনটি নয়, সেটা জানবার জন্যে এখন আর লেখককে প্রকাশকের মুখাপেক্ষি হয়ে থাকতে হচ্ছে না। প্রকাশকও খুব সহজেই পাঠকের চাহিদা বুঝতে পারছেন। আর অন্যদিকে পাঠকও একটি বই এর রেটিংস ও মন্তব্য পড়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে যে, ঠিক কোন বইটা সে পড়তে চায়।
প্রতিযোগিতা
ই-বুক যতটা না জনপ্রিয়তা পাচ্ছে বর্তমানে সবখানে, ততটাই হারাচ্ছেও। আর এর পেছনে কাজ করছে মোবাইলের উত্কর্ষতা। ‘প্রতিনিয়ত মোবাইলের স্ক্রিনগুলো বড় হচ্ছে, আর সঙ্গে সঙ্গে এটি তার জমকালোভাবটাও হারিয়ে ফেলছে’-বলেন জিম হিংকস।

অনেক ধরনের নতুন নতুন ব্যাপার তৈরি করে সবাইকে ই-বুক এর দিকে টেনে রাখতে চাইছে প্রতিষ্ঠানগুলো। রুক নামের একটি ই-প্রতিষ্ঠান বর্তমানে বিনা মূল্যেই কিছু কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় বই ডাউনলোডের সুবিধা দিচ্ছে সবাইকে।
প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বুকমেশিনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা লরা সামারসের মতে বর্তমানে মোবাইলে খেলা, খবরের কাগজ, অ্যাপসসহ আরো অনেক বেশি জিনিসের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে ই-বুককে। ফলে খানিকটা হলেও মনযোগ হারাচ্ছে এটি পাঠকদের। আর সত্যি বলতে কী কোথাও বসে হাতে এক কাপ কফি নিয়ে বই পড়া আর একটা যন্ত্রের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার ভেতরে অনেকটা পার্থক্য রয়েছে।
এ ছাড়া দিনকে দিন নানারকম প্রযুক্তির বাজে দিকগুলোর সামনে আসতে শুরু করেছে। মানুষ খুব দ্রুত নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে শুরু করেছে প্রযুক্তির মাধ্যমে। কখনো সেটা শারীরিক, কখনো মানসিক। আর তাই বলা যায়, ই-বুক মানব জীবনকে যতটা বেশিই আচ্ছন্ন করে ফেলুক না কেন ছাপা হরফের বই এর চাহিদা কখনোই শেষ হয়ে যাবেনা! প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নয়, সহায়ক হিসেবেই প্রতিটা সময় কালো কালিতে ছাপা বই এর পাতার পাশে থাকবে ই-বুক সবসময়।

Post a Comment

0 Comments